ফুটফুটে সকাল ও কিছু পবিত্র মুখ

বসন্তের ফুটফুটে সকাল। শিক্ষার্থীরা এক-এক করে হলরুমে জড়ো হচ্ছে; ধীরে ধীরে চঞ্চল হয়ে উঠছে অনুষ্ঠানস্থল।

তারুণ্যের চাঞ্চল্যের সঙ্গে একটি পবিত্রতার আবহও তৈরি হচ্ছে। যারা আজ অনুষ্ঠানস্থলে আসছে, তারা নিজের মনকে বিশুদ্ধ করে স্কুলের অন্য শিক্ষার্থীদের কাছে নৈতিকতার বার্তা পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে।

তাদের হাতে একটি করে ‘নৈতিক শিক্ষা ওয়ার্কবুক’ তুলে দেওয়া হবে। নৈতিক-অনৈতিক কাজের তালিকা, ভালো-র প্রতিষ্ঠা এবং মন্দ প্রতিহত করা নিয়ে মতামত, করণীয় ও পরিকল্পনা সম্বলিত বইটি শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করে ইটুএসডি।

১৬ মার্চ ২০২৩, রাজধানীর গবর্নমেন্ট সায়েন্স হাই স্কুলের যে ৩০ জন শিক্ষার্থীর হাতে বইটি তুলে দেওয়া হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথা বলবেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব মাহমুদ হাসান, ইটুএসডি-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী আলী রেজা এবং স্কুলের প্রধান শিক্ষক রহিমা আক্তার। অন্য শিক্ষকরাও আছেন অনুষ্ঠানস্থলে। আছেন ইটুএসডি-র অন্য কর্মকর্তারাও।

কাজী আলী রেজা মাইক হাতে নিয়ে যথারীতি নৈতিকতার মৌলিক ধারণা প্রদান এবং উপস্থিত শিক্ষার্থীদের দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা করতে করতে শিক্ষার্থীদের ভয় ও সংকোচের আগল ভাঙলেন। প্রশ্ন করলেন, প্রশ্ন শুনলেন, উত্তরও দিলেন।

তিনি শিক্ষার্থীদের কাছেই জানতে চাইলেন আজ তারা কী কী ভালো কাজ করেছে। শিক্ষার্থীদের নিষ্পাপ মুখ থেকে অকপট কিছু বক্তব্য বেরিয়ে এলো, যা ছিল অসাধারণ!

আবীর হোসেন মাহিম বলল, ‘বাসা থেকে আসার সময় দেখলাম, অটোরিকশার ধাক্কা লেগে এক ভদ্রলোক রাস্তার পাশে পড়ে গিয়েছিলেন। ধাক্কা প্রচণ্ড ছিল; তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলেন। কাঁধে বইয়ের ব্যাগ নিয়ে আমি পানি আনার জন্য দৌড় দিই। তার মাথায় পানি ঢালার কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফেরে। এরপর আহত ভদ্রলোকের মোবাইল থেকে ভাইয়ের ফোন নম্বর নিয়ে তাকে ফোন দিই। তিনি এসে ভদ্রলোককে হাসপাতালে নিয়ে যান। এ কাজটি করতে পেলে বেশ ভালো লাগছে।’

উপস্থিত সবাই মাহিমের এ ভালো কাজের জন্য করতালি দিলেন।

এরপর শুরু করল মাওদুদ আহমাদ মাহিন। বলল, ‘স্কুলে আসার সময় এক বিষণ্ন পথশিশু দেখলাম। তার চেহারায় ক্ষুধার তীব্রতা ছিল। সে জানাল, তার বড় ভাই চায়ের দোকানে কাজ করলেও তার খবরাখবর নেয় না। দারুণ অযত্ন আর অবহেলার চিহ্ন ছিল তার শরীরে। আমার মায়া হলো। আমি তাকে মায়ের দেওয়া টিফিনের টাকা খরচ করে পেট ভরে খাইয়েছি। ছেলেটি মুখে হাসি ফুটল। সে আমাকে ধন্যবাদ দিল।’

অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত সবাই ‘বাঃ বাঃ’ বলে মাহিনকে ধন্যবাদ জানালেন।

আজ স্কুলে আসার সময় মায়ের কাপড় ধুয়ে দিয়েছে হাসান মাহমুদ শাফি। এ কথা ভরা মজলিসে জানাতে দ্বিধাবোধ করল না সে। কারণ কাজী আলী রেজা যে পরিবেশ তৈরি করেছেন, তাতে এ ধরনের বক্তব্য বলিষ্ঠ কণ্ঠে তুলে ধরাই কৃতিত্বের।

শাফির সঙ্গে যোগ করল মিরাজ হোসেন শুভ। সে জানাল, মায়ের কাপড় ধুয়ে দেওয়ার পর বাসার থালা-বাসনও পরিষ্কার করে দিয়েছে সে।

রেদওয়ান খান কিয়াম জানাল, শুধু আজ নয়, সে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ির কাজে মা-কে সহযোগিতা করে। তরকারি, পেঁয়াজ, মরিচ কেটে দিয়ে মাকে রান্নায় সাহায্য করে।

বাবা-মা যখন ঘুমিয়ে পড়েন, তখন সাদমান সাকিব খান পড়ার টেবিল থেকে উঠে বাসার সব থালা-বাসন পরিষ্কার করে। তার মায়ের পা-ফাঁটা। মা ঘুমিয়ে পড়লে সে মায়ের পায়ে আলতো করে হাত দিয়ে লোশন লাগিয়ে দেয়।

অসাধারণ!

যে সময়ে সমাজ থেকে বড়দের প্রতি সম্মান কিংবা বিপদগ্রস্ত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসাটা গৌণ, সেখানে গবর্নমেন্ট সায়েন্স হাই স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিষ্পাপ মুখ-নিঃসৃত এসব বক্তব্য অন্যদের উদ্বেলিত করবেই। তাই হলো, শিক্ষার্থীদের বক্তব্য যখন শেষ, তখন অতিথি কিংবা শিক্ষকরা নিজের অজান্তেই কিছুক্ষণ নীরব থাকলেন। হয়তো, তারা শৈশবের সময়ে ফিরে গিয়ে প্রিয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেকে খুঁজতে থাকলেন। পেলেনও।

কাজী আলী রেজা বক্তব্য শেষ করার পর মাইক নিলেন মাহমুদ হাসান। তার বক্তব্যের গভীরতা, সাবলীল উপস্থাপনা, শ্রোতাদের মনে ঢুকে পড়ার কৌশল অসাধারণ। উপস্থিত সবাই তার বক্তব্যে নিমগ্ন হয়ে গেলেন। শিক্ষার্থীরা তন্ময় হয়ে তার কথা শুনল।

তিনি জানতে চাইলেন, ‘অতিরিক্ত কিছু কি খারাপ?’

সবাই উত্তরে বলল, ‘জি স্যার।’

তিনি একটু হেসে বললেন, ‘আমি তো অতিরিক্ত সচিব ছিলাম, আমি কি খারাপ?’

উত্তরে সবাই হো হো করে হেসে উঠলেন। শিক্ষার্থীরা বুঝতে পারল, সব অতিরিক্ত খারাপ নয়। তিনি ব্যাখ্যা করলেন, অতিরিক্ত জ্ঞান অর্জন করা খারাপ নয়, অতিরিক্ত ভালো হওয়া খারাপ নয়।

শিক্ষার্থীরা তার কাছে নতুন কিছু শিখল। মাহমুদ হাসান বললেন, ‘বাবা-মা চান, সন্তান তাদের চেয়ে বড় হোক, শিক্ষক চান, শিক্ষার্থীরা তার চেয়ে বড় হোক। তোমাদেরকে নৈতিকতার পথ ধরে সেই চাওয়া পূরণ করে সমাজের হাল ধরতে হবে।’

তিনি জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কি সমাজে নিজেকে নৈতিকতার মডেল হিসেবে উপস্থাপন করতে পারবে?’ সমবেত উত্তর এলো, ‘পারব স্যার, অবশ্যই পারব।’

তার বক্তব্য শেষ হলে মাইক হাতে নেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক রহিমা আক্তার। তিনি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কল্যাণে এই মহতি উদ্যোগ নেওয়ার জন্য ইটুএসডিকে ধন্যবাদ জানান।

‘সমাজ যে পথে এগোচ্ছে, তাতে নৈতিকতা শব্দটা আজ মুখ্য কোনো বিষয় নয়। শিক্ষার্থীরা সবই শিখছে, কিন্তু নৈতিকতা শিখছে না। এ সময়টাতে ইটুএসডি-র এগিয়ে আসা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য সৌভাগ্যের’- বেশ বলিষ্ঠতার সঙ্গে বললেন রহিমা আক্তার।