ব্যবসায় শুধুই নিজের কল্যাণের জন্য নয় বরং জনকল্যাণ ও ব্যবসায়িক ব্যবস্থাপনার একটি অংশ। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিচালকরা যদি এগুলো নিয়ে ভেবে-চিন্তে ব্যবসা পরিচালনা করেন, সে ক্ষেত্রে তার কর্মী বাহিনী যেমন নৈতিক মানদন্ড মেনে চলার চেষ্টা করবেন, তেমনি গোটা জাতি উপকৃত হবে এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত হবে। সেই লক্ষ্যে সকলের সচেতনতা কাম্য।

বক্তারা সবাই সার কথা হিসেবে বললেন, ‘অধিক মুনাফার লোভে ব্যবসা কার্যক্রম পরিচালনা করা অনৈতিক কাজ।’ ১১ জুন ২০২৩ এথিক্স এডুকেশন ফর সাসটেইনব্যল ডেভেলপমেন্ট ও আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস-য়ের যৌথ উদ্যোগে ব্যবসায় ও নৈতিকতা বিষয়ে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। সেমিনারের শিরোনাম ছিল ‘ইম্পর্টেন্স অব বিজনেস এথিক্স-পার্সপেক্টিভ বাংলাদেশ‘। বিকেল সাড়ে তিনটায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি-অডিটরিয়ামে শুরু হওয়া সেমিনারটি শেষ হয় সন্ধ্যা ছয়টায়।
আমরা জানি ব্যবসায় যদি উদ্যেক্তার লাভ বা মুনাফাই প্রধান হয়ে ওঠে এবং এর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব যদি অন্যদের অর্থাৎ ব্যবসায় থেকে সেবা গ্রহীতার ক্ষতি হয় কিংবা ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে তাহলে সেই ব্যবসায় কতটা বৈধ বা আইনসম্মত তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। ব্যবসার দু‘টি দিক। এক. মুনাফা অর্জন, দুই. সেবা প্রদান। সাধারণত আমাদের মতো দেশে মুনাফা অর্জনই একমাত্র এবং প্রধান লক্ষ্য হয়ে উঠেছে। আমাদের দেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভোক্তার অধিকার রক্ষিত হচ্ছে না। এর প্রধান কারণ মানুষের নৈতিক ও মানবিক ভিত্তি বর্তমান সময়ে খুবই দুর্বল।
এই সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন সোয়ান গ্রুপের চেয়ারপার্সন খবির উদ্দিন খান এবং মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন-য়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মেলিতা মাহজাবিন। সোশ্যল বিজনেস প্র্যাক্টিসেস বিষয়ে এবং এথিক্স ইন সিকিউরিটিজ ট্রেইডিং নিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেন আইএলও লেব্যর স্ট্যান্ডার্ড এক্সপার্ট টিআইএম নুরুন্নবী খান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি ইউনিভার্সিটির গিবন্স প্রফেসর অব ফিন্যান্স ড. জাহাঙ্গীর সুলতান।
উদ্বোধনী ভাষণ দেন আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ফাজলি ইলাহি। সেমিনারে সভাপতি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের সভাপতি কাজী রফিকুল আলম।
মূল উপস্থাপক বাকচাতুর্যে কিছুটা নাটকীয় মুহূর্ত তৈরি করে উপস্থাপনা অংশগ্রহণমূলক ও আকর্ষণীয় করে তোলেন। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য কিছু লিংক দিয়ে দেন ইন্টারনেটে অনুসন্ধানের জন্য। সেমিনারে আরো বক্তব্য তুলে ধরেন হজ্জ ফাইন্যান্স কোম্পানী লিমিটেডের ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ লকিওতউল্লা, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক ড. আবু তৈয়ব আবু আহমেদ। ই২এসডি-র পরিচিতি প্রদান ও অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ই২এসডি-র সিইও কাজী আলী রেজা।
ব্যবসায় ও নৈতিকতা প্রসঙ্গে সাধারণ ক্রেতাদের তাৎক্ষণিক সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি প্রতিবেদন পেশ করেন ব্যুরো অফ নন ফরমাল এডুকেশন এর ডেপুটি ট্রেনিং কোঅর্ডিনেটর মো. সাইফুজ্জামান রানা যেখানে দেখা যায় ক্রেতারা বলেছেন লোভ, জবাবদিহিতার অভাব এবং নৈতিকতার অবক্ষয়ের জন্যই ব্যবসায়ে অনৈতিকতা বেড়ে গেছে।

সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন আহছানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেস এন্ড সোশ্যল সায়েন্স-য়ের ডীন অধ্যাপক ড. সালেহ মোহাম্মদ মাশেদুল ইসলাম।
ড. মেলিতা মেহজাবীন তাঁর উপস্থাপনায় ব্যবসায়ের অনৈতিক কয়েকটি দিকের বিশ্লেষণ করেন এবং সমাধানের কিছু উপায় উল্লেখ করেন। তিনি বলেছেন, ”কনজিউমারদের প্রতি ব্যবসায়ীদের দায়িত্ববোধের প্রসঙ্গেই আসে বিজনেস এথিক্স। পণ্যের মান এবং উল্লেখিত পরিমান প্রসঙ্গেই এই দায়িত্ববোধ”

টিআইএম নুরুন্নবী খান সোশ্যলি রেসপন্সিব্যল বিজনেস প্র্যাকটিসেস শিরোনামের উপস্থাপনায় আইএলও স্ট্যান্ডার্ড তুলে ধরেন এবং বলেন, সামাজিক দায়বদ্ধতা পালন করলেই উইন-উইন অবস্থা তৈরি হবে এবং সকল ব্যবসায় দৃঢ় ভিত্তি পাবে, এসডিজি-তে অবদান রাখবে।

ড. জাহাঙ্গীর যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে যুক্ত হয়ে ইনসাইডার ট্রেইডিং এন্ড এনফোর্সমেন্ট শিরোনামের উপস্থাপনায় বৈশ্বিক অবস্থান এবং বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে অনৈতিকতার কিছু দৃষ্টান্ত দর্শক- শ্রোতাদের সামনে নিয়ে আসেন।

প্রধান অতিথি খবিরউদ্দীন খান নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ‘আমি আমার তৈরি দ্রব্য সম্পর্কে সত্য কথা বলি, আমার প্রতিনিধিদের বলেছি সবসময় সত্য কথা বলার জন্য। ক্রেতাদের সঙ্গে আমরা কোনোভাবেই প্রতারণার আশ্রয় নেই না। এভাবে ব্যবসা করেই আমি মুনাফা করি। আমি সীমিত মুনাফাতেই সন্তুষ্ট। অতি মুনাফার লোভে অনেক ব্যবসায়ী অনৈতিক পন্থা নিয়ে ক্রেতাদের নানাভাবে ঠকাচ্ছেন।’ তিনি বলনে, ‘সামাজিক দায়িত্ববোধ মেনে ব্যবসা করা উচতি,ব্যবসায় নৈতিকতা থাকা খুবই গুরুত্বর্পূণ। এছাড়া ভাল উদ্যোক্তা হওয়া খুব প্রয়োজন আমাদরে দেশে। পাশাপাশি ভাল ছাত্র হবার আগে ভাল মানুষ হতে হবে। আর প্রতিদিনের জীবনে শৃঙ্খলা খুব বেশি প্রয়োজন।’

সভাপতি কাজী রফিকুল আলম তার বক্তব্যে বলেন, ঢাকা আহ্ছানিয়া মিশন ও নর্থ আমেরিকা বাংলাদেশী ইসলামী কমিউনিটি একটি নৈতিক সমাজ গঠনে তাদের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এথিক্স এডুকেশন ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গঠিত হয়েছে সেই উদ্দেশ্য সামনে রেখে। আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনলজি এই প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করছে। আজকের শিক্ষার্থীরা আগামীদিনের দেশ গড়ার কারিগর। তারা জীবনের একটি নৈতিক দিক সম্পর্কে আজকে বিস্তারিতভাবে জানলেন। তাদের কর্মজীবনে নিশ্চয়ই তারা এর প্রতিফলন ঘটাবেন- সেই বিশ্বাস আমার আছে।
সভাপতির বক্তব্যের পর প্রধান অতিথি ও বক্তাদের স্মারক হিসেবে ক্রেস্ট প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যবসায় অনৈতিকতা যেন বেড়েই চলেছে। প্রায় সকল ব্যবসায়ী স্বল্পতম সময়ে শতকোটি টাকার মুনাফা অর্জন করতে চান। তারা ক্রেতাকে ঠকান, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করে রাজনৈতিক দলের প্রভাব খাটিয়ে ঋণখেলাপী হয়ে বিদেশে টাকা পাচার করেন। ব্যবসায় অনৈতিক কাজের মধ্যে রয়েছে খাদ্যে ভেজাল/মাছ ও সবজিতে ফরমালিন/বেকারির অস্বাস্থ্যকর খাদ্যপণ্য/মসলায় ভেজাল/ফলে(ফ্রুটস) কেমিক্যাল-স্প্রে/মুড়িতে ইউরিয়া/দুষিত পানি বোতলে/দুধে ভেজাল, ওজনে কম দেওয়া, প্রতারণা ইত্যাদি।
মানুষের নৈতিক স্খলন ঘটেছে বলেই মানুষের ও সমাজের ক্ষতি হবে জেনেও কেউ কেউ ব্যক্তিগত লাভের আশায় অনৈতিক ব্যবসায় পরিচালনা করছে। এই সব অপরাধের শাস্তির পাশাপাশি নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধই পারবে এগুলো প্রতিরোধ করতে।