শিশুরা যখন আমাদের শিক্ষক

যে শিশুটি ছোট ছোট পায়ে স্কুলের দিকে এগোতে এগোতে এটা-ওটা দেখছে, সে কি নিবিড়ভাবেই সব দেখছে?
এর উত্তর- হ্যাঁ।
শিশু-মস্তিষ্ক কি সমাজের জীবন্ত ছবি ঠিকমতো ধারণ করতে পারছে?
এর উত্তর- হ্যাঁ।
শিশু কি তার দেখা দৃশ্যগুলোর ভালোমন্দ নিখুঁতভাবে বিচার করতে পারছে?
এর উত্তর- হ্যাঁ।
আচ্ছা, তার চোখ ও মনে আটকে থাকা সমাজের মন্দগুলো সংশোধনের জন্য সে কি বড়দের মতো ভাবছে?
এর উত্তর- হ্যাঁ।

আমরা যে বলি- ‘ছোট মানুষ, সে কী বুঝবে’, এই ধারণা যে একেবারে ভুল, তা পরিষ্কার হলো রাজধানীর আহছানিয়া মিশন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। শিক্ষার্থীদের মাঝে ‘নৈতিক শিক্ষা ওয়ার্কবুক’ বিতরণ অনুষ্ঠানে। নৈতিক শিক্ষাকে অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে বিনামূল্যে বইটি বিতরণ করে এথিকস এডুকেশন ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (ইটুএসডি)।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন ইটুএসডি-র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কাজী আলী রেজা। তিনি শিক্ষার্থীদের জড়তা দূর করতে বিশ্বকাপ ফুটবল প্রসঙ্গ টেনে আনলেন। জানতে চাইলেন, ‘বিশ্বকাপের সময় তোমরা কি প্রিয় দলের পতাকা উড়িয়েছ?’

‘হ্যাঁ উড়িয়েছি’- সমস্বরে বলল শিক্ষার্থীরা।

‘কে কে মেসিকে ভালোবাস?’

অনেকে হাত তুলে বলল- ‘ভালোবাসি।’

‘রোনালদোকে ভালোবাস কে কে?’

অনেকে হাত তুলে জানান দিল, তারা রোনালদোর ভক্ত।

কেউ কেউ হাত তুলে জানাল, তারা নেইমারকে ভালোবাসে।

কাজী আলী রেজা বললেন, ‘ভালো। বল তো, তোমরা কি শুধুই তাদের ভালোবাস, নাকি তাদের মানবিক দিকগুলোকেও ভালোবাস? আই মিন, তাদের ভালো দিকগুলো নিজের জীবনে চর্চা কর?’

এবার আগের মতো উত্তর এলো না।

কাজী আলী রেজা বললেন, ‘মেসি, রোনালদো, নেইমার- এদের মানবিক গুণাবলি অনেক দৃঢ়। তারা আয়ের বিশাল অংশ অসহায় মানুষের জন্য, বিশেষত দরিদ্র শিশুদের জন্য ব্যয় করেন।’

তিনি জানতে চাইলেন, ‘তোমরাও কি বড় হয়ে মানবতার সেবায় কাজ করবে?’

সবাই বলল, ‘জি, স্যার।’

এবার তিনি জানতে চাইলেন, ‘আজ স্কুলে আসার সময় তোমরা এমন কিছু কি দেখেছ, যা তোমাদের খারাপ লেগেছে?’

রাইয়ান বলল, ‘এক রিকশাচালক প্রকাশ্যে ধূমপান করছিলেন। অথচ, এটা অন্যায়।’
আবু ওবায়দা বলল, ‘কারও বারান্দা থেকে পলিথিনে মোড়া কিছু ময়লা রাস্তায় ফেলা হলো। সবাই উপরে তাকাচ্ছিলেন।’
তাপস বলল, ‘দেখি, দুজন তীব্র ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েছেন। মানুষ থামাতে চেষ্টা করছিলেন, থামছিল না।’
সাকিব বলল, ‘বিশ্রী দৃশ্য। দেখি, রাস্তার পাশে এক লোক পেশাব করছেন।’
রমা বলল, ‘মোটর সাইকেল চালকের সঙ্গে ট্রাক চালকের কী একটা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছে। তারা বাজে সব শব্দ ব্যবহার করছেন। কেউ সমাধানে এগিয়ে আসছেন না; দূর থেকে হাসাহাসি করছেন।’
রিফাত বলল, ‘এক ভদ্রলোক গাছ কেটে রাস্তার মাঝখানে ফেলে রেখেছেন। গাড়ি চলাচল করতে পারছিল না।’
সাদিয়া বলল, ‘এক লোক হয়তো ভাড়া কম দিয়েছেন, তাই রিকশাচালকের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হচ্ছিল। অনেক জোরে কথা বলছিলেন তারা।’

কাজী আলী রেজা বললেন, ‘আমাদের সবাইকে মিলে এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে। ছোট-বড় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।’

শিক্ষার্থীরা একযোগে বলল, ‘জি, স্যার।’

এবার তিনি জানতে চাইলেন, ‘তোমরা প্রতিদিন স্কুলে এসে এমন কিছু কি কর, যা করা উচিত নয়?’

নিঃসংকোচে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভুলগুলো তুলে ধরল-

  • আমরা স্কুল-আঙিনার যেখানে-সেখানে ময়লা ফেলি।
  • গাদাগাদি করে সামনে বসতে চাই।
  • স্কুলের ছোট-বড় অনেক নিয়ম মানি না।
  • ক্লাসে মনোযোগ না দিয়ে পাশের সহপাঠির সঙ্গে কথা বলি।
  • দেওয়ালে লিখি।
  • দুই ক্লাসের মধ্যবর্তী সময়ে হৈ চৈ করি।
  • শিক্ষককে যথাযথ সম্মান করি না।
  • শিক্ষককে মিথ্যা তথ্য দিই।

কাজী আলী রেজা জানতে চাইলেন, ‘তোমরা কি আমাকে প্রতিশ্রুতি দেবে, এই মুহূর্ত থেকে এসব বর্জন করবে?’

সবাই হাত তুলে নিজেকে সংশোধন করার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করল।

কাজী আলী রেজা জানতে চাইলেন, ‘আমরা আজকে বাসায় এমন কিছু কি করেছি, যা করা উচিত হয়নি?’

একজন বলল, ‘মায়ের সঙ্গে মিথ্যা বলেছি।’
আরেকজন বলল, ‘জোর করে খাওয়ানোর কারণে মাকে বকা দিয়েছি।’
আরেকজন বলল, ‘কুকুরকে লাথি দিয়েছি।’

বক্তা প্রশ্ন করার আগেই কেউ কেউ দাঁড়িয়ে বলল, ‘বাসায় কিংবা স্কুলে, আমাদেরকে ভুল কাজগুলো পরিহার করতে হবে। নিজেদেরকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, সবাই যেন আমাদের দেখে ভালো হয়।’

এ-ই যে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ভুলের জন্য অনুশোচনা, ভালো কিছু করার তাগাদা- এটি তৈরির জন্যই কাজ করে যাচ্ছে ইটুএসডি।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত বক্তারা ইটুএসডি-র এই মহতি উদ্যোগের প্রশংসা করলেন। সময় যখন দিনদিন কঠিন হচ্ছে, মানুষের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ এবং সততা ধীরে ধীরে উবে যাচ্ছে, অন্যায় করতে মানুষ কুণ্ঠিত হচ্ছে না, তখন এই উদ্যোগ সমাজ পরিবর্তনে বড় ভূমিকা রাখবে- এমন প্রত্যাশা তাদের।